যুগে যুগে রাজা বাদশারা নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিতেই তৈরি করেছেন বিভিন্ন মসজিদ এবং স্থাপত্য। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে নানা স্থাপত্য। যেগুলোর কোনোটি সাক্ষ্য দিচ্ছে মুঘল আর কোনোটি সুলতানি কিংবা ব্রিটিশ আমলের।
ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ছিলেন স্বাধীন মুসলিম সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। চৌদ্দ শতকে তিনিই ছিলেন বাংলার সার্বভৌম ‘সুলতান’। তার শাসনকাল ছিলো ১৩৩৮- ১৩৪৯ খৃষ্টাব্দ। রাজধানী ছিল ঢাকার অদূরস্থ ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের কথিত দ্বিতীয় রাজধানী ছিলো বর্তমান বাংলাদেশের ফেনী জেলার শর্শদি ইউনিয়নে। বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও চট্টগ্রামের পর ত্রিপুরা ও আরাকান রাজ্য জয় করে এতদঞ্চলে দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি ফেনী জেলার শর্শদিতে রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন।
দেশের যেকোনো জায়গা থেকে প্রথমে ফেনীর মহীপাল গিয়ে মহীপাল থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে মোহাম্মদ আলী বাজার এবং সেখান থেকে একটু পশ্চিমেই শর্শদি ইউনিয়ন। সুলতানি আমলে বেশ কিছু বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্পে হাত দেন মুবারক শাহ, যার মধ্যে মহাসড়ক, বাধ, মসজিদ ও সমাধি ছিল অন্যতম। এখনো সুলতানি আমলের বেশকিছু নিদর্শন টিকে আছে শর্শদিতে। ফেনী জেলার শর্শদিতে সুলতান মুবারক শাহের প্রতিষ্ঠিত একটি সেনানিবাস ও হাম্মামখানা রয়েছে।
বাংলার স্বাধীন সুলতানি স্থাপত্যের অন্যতম একাটি নিদর্শন মুবারক শাহ মসজিদ। ১০৮০ হিজরিতে নির্মিত এই মসজিদটি নির্মান করেন বীর মুজাহিদ মোহাম্মদ আলী। প্রায় ৬৮০ বছরের প্রাচীন মুবারক শাহ মসজিদ নামে খ্যাত এই এই স্থাপনাটিতে ফুটে উঠেছে দুর্গের আদলে অজস্র ফুলেল নকশা, দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন খন্ডাকৃতির নকশা। তিন গম্বুজ আকৃতিবিশিষ্ট এই মসজিদের তিনটি প্রবেশদ্বার এবং মেহরাবের সম্মুখে রয়েছে অপূর্ব ফুল লতাপাতার নকশা। মসজিদের ঢোকার সম্মুখে দেয়াল ও চুন সুরকির শৈল্পিক আবহে নির্মিত।
পুরো মসজিদটি চুন, সুরকি আর ইটের তৈরি।স্থানীয়ভাবে এই মসজিদটি তাকিয়া মসজিদ এবং গায়বী মসজিদ নামে বহুল পরিচিত। সুলতানি শাসন আমলে নির্মিত এই মসজিদে ফুটে উঠেছে উপমহাদেশের ইসলামিক প্রতাপ ও ঐতিহ্য।
বর্তমান স্থাপনাগুলোয় সাধারণত ছয় ইঞ্চি পুরু দেয়াল দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্গের আদলে নির্মিত এই মসজিদের দেয়াল প্রায় পাঁচ ফুট পুরু। মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনস্থ একটি পুরাকির্তি সংরক্ষিত এলাকা। বাংলাদেশের ৪৭ টি প্রাচিন মসজিদকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেয়া হয়েছে তার মধ্যে মুবারক শাহ মসজিদ অন্যতম।
এই মসজিদে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। স্থাপনাটির রক্ষণাবেক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি নোটিশ ছাড়া আর কোন কর্মকান্ডের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এমনকি মসজিদের নাম বা ইতিহাস নিয়ে কোন তথ্যও কোথাও লিপিবদ্ধ নেই, যাতে করে ঔৎসুক পর্যটকদের জিঘাংসা মিটাতে পারে।
এছাড়াও ফেনীর সর্বপ্রাচীন শর্শদি মাদ্রাসার মূল মসজিদের পাশেই রয়েছে সুলতানি স্থাপনার আরো একটি অপূর্ব নিদর্শন ঐতিহাসিক মোহাম্মদ আলী মসজিদ।
শর্শদি মাদ্রাসাস্থ এই মসজিদটি ১১০০ হিজরির প্রথম ভাগে নির্মিত হয়।এই মসজিদটিও মুবারক শাহ'র আমলে নির্মাণ করেন বীর মুজাহিদ মোহাম্মদ আলী চৌধুরী।
প্রায় ৬৫০ বছরের পুরোনো এই মসজিদটির গায়ে নকশা অঙ্কন করা হয়েছে সুনিপুন হাতে। গম্বুজের নিচে রয়েছে শৈল্পিক আবহ। দারুণ কারুকার্যময় ৩ টি গম্বুজ বেষ্টিত এই মসজিদের ঢোকার সম্মুখে দুপাশে রয়েছে দেয়াল ও চুন সুরকির নির্মিত দুটি ক্ষুদ্র আকৃতির মিনার। মসজিদটির ঐতিহাসিক নাম মোহাম্মদ আলী মসজিদ হলেও স্থানীয়ভাবে এটি শর্শদি মাদ্রাসা মসজিদ নামেই বহুল পরিচিত।
শর্শদি মাদ্রাসা থেকে একটু উত্তরে এগোলেই চোখে পড়ে মুবারক শাহ মসজিদ। মসজিদটির সামনে দিয়ে কুমিল্লা - ফেনী পর্যন্ত চলে গেছে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সড়ক। সড়কের পুর্ব দিকে রয়েছে কেল্লা শাহ'র মাজার। মাজার থেকে একশ গজ সামনেই রয়েছে বিশাল মহামানিক্য রাজের দিঘি বা পরীর দিঘি। ত্রিপুরার রাজা প্রতাপ মানিক্য এই দিঘিটি খনন করেন। প্রতাপ মানিক্য রাজের বাবা ছিলেন মহারাজ ধর্মমানিক্য। যিনি খনন করেন কুমিল্লার ঐতিহাসিক ধর্মসাগর দীঘি।
ধর্মমানিক্যের বাবা মহামানিক্যের হাতেই ত্রিপুরা রাজবংশের সূচনা হয়েছিলো। প্রতাপ মানিক্য তার ঠাকুরদা মহামানিক্যের নামেই এই দিঘির নামকরন করেছিলেন। তবে স্থানীয় প্রবীণরা ছাড়া এই দিঘির নাম খুব কম মানুষই জানে।
স্থানীয় বেশিরভাগ লোকজনই এই ঐতিহাসিক দীঘিকে শর্শদি দীঘি নামেই চিনে থাকে। বর্তমানে এই দীঘিটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে রেখে মাছ চাষ করা হচ্ছে। অপূর্ব এই দিঘিটি বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ দীঘিগুলোর মধ্যে একটি।
স্বাক্ষী বহনকারী ঐতিহাসিক ঢাকা-চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের পার্শ্বে ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়ন। কাল পরিক্রমায় শর্শদি ইউনিয়ন শিক্ষা, সংষ্কৃতি, ধর্মীয়, অনুষ্ঠান, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্বকীয়তা আজও সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে মলিন হয়ে গেছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এসব স্থাপনা টিকিয়ে রাখতে সরকার ও সর্বসাধারণের সচেতনতা ও সচেষ্ট থাকা দরকার। গৌরবের ইতিহাস যেনো কালের গর্ভে না হারিয়ে যায়।