কর্ণফুলীর ঘোলা পানি। ভাটার টান। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কার্গো স্টিমারগুলি একটু পর পর ভোঁস ভোঁস আওয়াজ তুলছে আর লম্বা সাইরেন দিচ্ছে। কেনো দিচ্ছে জানিনা। এদিক ওদিক ভটভট ইঞ্জিনের আওয়াজ তুলে সাম্পানের ছোটাছুটি, যেনো কতো ব্যস্ততা। আর সারাদিনের ক্লান্তিশেষে কিছু পথিক কিংবা বেড়াতে আসা মানুষের সান্ধ্য পায়চারী। কয়েকজন যুগলের কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকা। নদীর ঘোলা পানিতে সোডিয়াম বাতির ছায়া। ছায়াগুলো কী অদ্ভুতভাবে ঢেউয়ের সাথে তাল মিলাচ্ছে।
- তুমি ওদিক তাকিয়ে চা খাচ্ছো!
কথাটা কাছ থেকেই এসেছে। তোয়াক্কা করিনি।
- তুমি ওদিক তাকিয়ে চা খাচ্ছো!
কথাটা আরো দু বার শোনার পর পাশ ফিরে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, আমাকেই বলছে। কথা বলা মানুষটা বছর পাঁচেকের একটি ফুটফুটে ছেলে, চশমার আড়ালের মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
জিজ্ঞেস করলাম, 'আমাকে বলছো?"
- তুমি পানির দিকে তাকিয়ে চা খাচ্ছো কেনো?
- আমার ভালো লাগছে তাই।
- তোমাকে গৌতমের মতো লাগছে!
- গৌতম! গৌতম কে?
- তুমি গৌতমকে চেনো না?!
- না তো, চিনি না।
- গৌতম হচ্ছে একজনের নাম। আমার মুনি সবসময় গৌতমের কথা বলতো, তুমি গৌতমের মতো।
- আচ্ছা!
- তোমার নাম কী?
নাম বললাম। এভাবেই আলাপটা শুরু। সে তার নিজের গল্প বলতে লাগলো। বাসার গল্প, স্কুলের গল্প, বেড়াতে যাওয়ার গল্প। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, কীভাবে একটা সম্পুর্ণ অপরিচিত মানুষের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলা যায়, যেনো কতো চেনা! অথচ অনেকদিন একসাথে থেকেও চিনে উঠতে পারিনা, বুঝে উঠতে পারিনা অনেককেই। ভাব জমানো তো অনেক দূরের ব্যপার। এজন্যেই বাচ্চারা নিষ্পাপ। আমরা যতো বড়ো হই ততো দূরের মানুষ হয়ে যাই,মরে গিয়ে হারিয়ে যাই।
কথায় কথায় সময় অনেকটুকু যাওয়ার পর ছেলেটার বাবা-মা এসে নিয়ে গেলো তাকে। তারা পাশেই ছিলো।
একটু পরই খেয়াল হলো ছেলেটার নামটাই জানা হয়নি! ইশ, এত্ত কথা বললাম, সে আমার নাম জানলো অথচ আমি তার নামটাই জেনে নিতে পারলাম না!
তিক্ততায় ভরা মনটা নিয়ে এসে বসেছিলাম।বসে চা খাচ্ছিলাম আর চোখের দৃষ্টি যতদুর গেলে ঝাপসা হয়ে যায় ততদুর বাড়িয়ে দিচ্ছিলাম। যেন চারদিকের কোলাহলে কিচ্ছু যায় আসেনা এমন ভাব। এর মাঝে হুট করে এসে ছেলেটা ভাব জমিয়ে মনে দাগ কেটে গেলো, অথচ নাম না জানানো আক্ষেপে রেখেই চলে গেলো। নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে। একটুপর ভাবলাম কীইবা হবে নাম জেনে। কতো মানুষ আসে যায়, কতো মানুষ খুব চেনা থেকে অচেনা হয় অথবা মরে যাওয়া মানুষটাকেই বা আমরা কতোদিন মনে রাখি? পাশে থাকা মানুষটারও খেয়াল রাখতে ভুলে যাই।
তবে না, ছেলেটাকে ভুলে যেতে হয়নি। কোত্থেকে দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আবারো আমার পাশে এসে বসলো।
- আমি আবারো এসেছি, তুমি এখনো বসে আছো?
- হ্যাঁ।
এবার আর ভুল করিনি, প্রথমেই জানতে চাইলাম,
- তোমার নামটা জানা হয়নি, নাম কী তোমার?
- আমার নাম আদিত্য, আদিত্য দেব, আদিত্য নারায়ণ দেব।তোমার নাম কী?
- আমি সাজ্জাদ। কোন ক্লাসে পড়ো আদিত্য?
- সেন্ট মেরিস, ক্লাস ওয়ান। আমি ছয় বছর।
- তোমার বয়স ছয় বছর?
- হ্যাঁ। তোমার স্মার্টফোন আছে? আমরা সেল্ফি তুলবো।
আমরা সেল্ফি তুললাম। ছেলেটার সামনের দাঁত পড়ে নতুন করে উঠতে শুরু করেছে। তাই 'র' কে 'ল' উচ্চারণ করছিলো।
- আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে, আসো চা খাই।
চা খেলাম।
হঠাৎ বললো,
- তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
- থ্যাংকিউ! তোমাকেও আমার পছন্দ হয়েছে।
তারপর বাবাকে বললো, 'বাবা ওর নাম্বার নাও, আমি পরে কথা বলবো।' আমার নাম্বার নিলো। আমাকে বললো, 'মুনস্টার রেস্টুরেন্টে অনেক টেস্টি খাবার রান্না হয়, আমরা যখন আসবো তুমিও এসো।গল্প করবো।'
বললাম, আচ্ছা।
- আমার ব্যাংকে আমি পয়সা জমাই। সবার থেকে শুধু পয়সা নিয়ে জমাই। আমার যখন অনেক পয়সা হবে,তখন ফোন কিনে তোমার সাথে কথা বলবো।
- আচ্ছা, তোমার যখনই ইচ্ছা হবে কল দিও।
- তোমার একটা ছবি তুলি? দিদাকে দেখাবো।
- ঠিকাছে তুলো।
বাবার ফোনে আমার ছবি তুললো খুশি মনে।
- টাটা, ভালো থেকো।
- তুমিও অনেক ভালো থেকো আদিত্য।
ধীরপায়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছি। হঠাতই মনটা খুব ভালো হয়ে গেলো। আমরা সবসময় মন ভালো করার কারণ খুঁজে বেড়াই। সবসময়। হয়তো জীবনের ফাঁকফোকরে হুট করেই এমন কোনো গল্প তৈরি হয়ে যায়, হয়তো এভাবেই মন ভালো করে দিয়ে যায় কেউ। কিন্তু আমার মন ভালো করে দেয়া গল্পগুলো হয় খুব ক্ষণিকের, ক্ষণস্থায়ী। তবে হাজারো ব্যস্ততা ব্যর্থতার মাঝে স্মৃতিটা হারায়না কখনো। হয়তো আবারো কোনো একদিন তিক্ততায় ভরা সন্ধায় বসে থাকবো। হুট করে হয়তো একটি ফোন কল আসবে, আর ওপাশ থেকে বলবে,
-আমি আদিত্য, আদিত্য দেব, আদিত্য নারায়ণ দেব।
- অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ
০৩/০৩/২০২১
অভয়মিত্র ঘাট, চট্টগ্রাম।